মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছের চাষ ব্যবস্থাপনা
লেখকঃ ড. জাহিদ পারভেজ সুখন
2016-11-16 15:22:19
Visited 12380 Times
১. পটভূমি
তেলাপিয়া
একটি বিশ্বজনীন মাছ যা একুশ
শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৎস্য
প্রজাতি হিসাবে বিবেচিত হয়। তেলাপিয়া
মাছ ১৯৭৪ সালে থাইল্যান্ড
থেকে বাংলাদেশে আনা হলেও বর্তমান
শতকের প্রথম দিকে চাষি
পর্যায়ে এটি জনপ্রিয় হতে
শুরু করে । মূলতঃ
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রচেষ্টায়
তেলাপিয়ার গিফট জাতটি জনপ্রিয়তা
পায়। তেলাপিয়া
মাছ অতি দ্রুত প্রজননক্ষম
হয় ও বাচ্চা দিয়ে
পুকুরে মাছের সংখ্যা বাড়িয়ে
দেয়, ফলে চাষ বানিজ্যিকভাবে
লাভজনক হয় না, অন্যদিকে
পুরুষ মাছ তুলনামূলকভাবে দ্রুত
বৃদ্ধি পায়। তাই,
তেলাপিয়ার মনোসেক্স জাতের (সকল পুরুষ)
একক চাষ বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়
ও লাভজনক একটি পদ্ধতি।
মৎস্য
গবেষণা ইনস্টিটিউট ও ওয়ার্ল্ডফিস সেন্টারের
প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে মনোসেক্স তেলাপিয়ার অনেক হ্যাচারি গড়ে
উঠেছে। সাধারণত
সদ্য জন্ম নেয়া তেলাপিয়া
লার্ভিকে হরমোন যুক্ত খাদ্য
প্রয়োগ করে মনোসেক্স পুরুষ
তেলাপিয়া উৎপাদন করা হয়। বর্তমানে
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সুপার
তেলাপিয়া ও ওয়ার্ল্ডফিস সেন্টার
কর্তৃক উদ্ভাবিত উন্নতজাতের তেলাপিয়া থেকে মনোসেক্স তেলাপিয়া
উৎপাদন করা হয়।
স্বর্ণলতা এগ্রো ফিশারিজ লিঃ
২০১১ সালে ইনোভিশন কনসালটিং
(প্রাঃ) লিঃ ও ক্যাটালিস্ট
এর সহায়তায় ভিয়েতনাম থেকে দ্রুত বর্ধনশীল
ভিয়েতনাম জাত তেলাপিয়ার ব্রুডস্টক
সংগ্রহ করে। ভিয়েতনাম
তেলাপিয়ার এই জাতটি বাংলাদেশে
প্রাপ্ত মনোসেক্স তেলাপিয়ার অন্যান্য জাত থেকে ২০-২৫% বেশী দ্রুত
বর্ধনশীল।
২. মনোসেক্স তেলাপিয়া
চাষের
গুরুত্ব
ভিয়েতনাম
জাতটি বাংলাদেশে প্রাপ্ত অন্যান্য মনোসেক্স তেলাপিয়া জাতের চেয়ে দ্রুত
বর্ধনশীল। এটি
৫-৮ মাসে ৫০০-৮০০ গ্রাম হয়ে
থাকে। পাখনার
বর্ণ কিছুটা লালচে, আকার
অনেকটা গোলাকার, ও পুরুত্ব বেশী
হওয়ায় বাজার মূল্য বেশী
পাওয়া যায়। চাষ
ব্যবস্থাপনা সহজ ও লাভের
পরিমান বেশী।
৩.
মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছের চাষ
৩.১ পুকুর নির্বাচন:
মনোসেক্স
তেলাপিয়া চাষের জন্য কম
কাদাযুক্ত এবং ৪-৬
মাস পানি থাকে এমন
পুকুর নির্বাচন করতে হবে।
নার্সারি পুকুর ১৫–২০
শতাংশ ও লালন পুকুর
২০-১০০ শতাংশ আয়তনের
হলে ভাল। তবে
আয়তন এর চেয়ে ছোট
বা বড় হতে পারে।
৩.২ পুকুর প্রস্তুতি
পুকুর
সেচে পানি শুকিয়ে অবাঞ্ছিত
মাছ ও অন্যান্য প্রাণী
দূর করতে হবে।
পুকুরের তলায় অতিরিক্ত কাদা
থাকলে তা উঠিয়ে ফেলতে
হবে। পুকুরের
পাড় মেরামত করতে হবে
এবং পাড়ে গাছ-পালা
থাকলে ডাল কেটে দিতে
হবে। প্রতি
শতাংশে ১ কেজি হারে
চুন প্রয়োগ করতে হবে। চুন
প্রয়োগের ২-৩ দিন
পর পুকুরে পানি দিতে
হবে। চুন
প্রয়োগের ৩-৫ দিন
পর প্রতি শতাংশে ৫০
গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০
গ্রাম টিএসপি সার প্রয়োগ
করতে হবে। পুকুরে
সার প্রয়োগের ২-৩ দিন
পর পোনা মজুদ করা
যেতে পারে।
৩.৩ পোনা সংগ্রহ
পুকুরে
চাষের জন্য ভিয়েতনাম জাতের
মনোসেক্স তেলাপিয়ার পোনা স্বর্ণলতা এগ্রো
ফিশারিজ লিঃ-এর হ্যাচারী
থেকে সংগ্রহ করা যাবে। পোনা
পলিথিন ব্যাগে অক্সিজেন দিয়ে
পরিবহণ করতে হবে।
৩.৪ মনোসেক্স তেলাপিয়ার
নার্সারি ব্যবস্থাপনা
হ্যাচারি
থেকে সাধারণত ০.২০-০.২৫ গ্রাম (৫০০০-৪০০০ টি/কেজি)
আকারের পোনা সরবরাহ করা
হয়। ছোট
আকারের এই পোনা নার্সারি
পুকুরে নার্সিং করে ওজন ১০-১৫ গ্রাম হলে
লালন পুকুরে ছাড়া উচিত।
৩.৪.১ পোনা
মজুদ
নার্সারি
পুকুরে প্রতি শতাংশে ১৫০০-২০০০ টি পোনা
মজুদ করা যায়।
পুকুরের পানির সাথে খাপ
খাইয়ে পোনা পুকুরে মজুদ
করতে হয়।
৩.৪.২ খাদ্য
প্রয়োগ
নার্সারি
পুকুরে পোনাকে ৪-৫
সপ্তাহ নিম্নহারে খাদ্য প্রয়োগ করতে
হবে।
নার্সারি
পুকুরে মনোসেক্স তেলাপিয়ার খাদ্য প্রয়োগ তালিকা:
আকার (পোনা/কেজি) প্রয়োগ
হার (দেহ ওজনের) প্রয়োগ মাত্রা
-৫০০০ ১০০% ৪ বার
৪০০০ ৭৫% ৪ বার
৩০০০ ৫০% ৩ বার
২০০০ ৪০% ৩ বার
১০০০ ৩৫% ৩ বার
৮০০ ৩০% ২ বার
৫০০ ২৫% ২ বার
৪০০ ২০% ২ বার
৩০০ ১৫% ২ বার
১০০ ১০% ২ বার
৩.৫ মনোসেক্স তেলাপিয়ার
চাষ ব্যবস্থাপনা
৩.৫.১ পোনা
মজুদ
পুকুর
প্রস্তুতির পর প্রতি শতাংশে
১০-১৫ গ্রাম ওজনের
২৫০ টি সুস্থ-সবল
পোনা মজুদ করতে হবে।
৩.৫.২ খাদ্য
প্রয়োগ
পোনা
মজুদের পর ২৫-৩০%
প্রোটিনসমৃদ্ধ ভাসমান খাবার নিম্নে
উল্লেখিত ছক অনুসারে প্রতিদিন
পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে।
৩.৫.৩ অন্যান্য
ব্যবস্থাপনা
প্রতি
৭-১০ দিন পর
পর জাল টেনে মাছের
বৃদ্ধি পর্যবেণ করে খাবারের পরিমাণ
নির্ধারণ করতে হবে।
মাছ নিয়মিত খাবার খায়
কিনা সেদিকে সজাগ দৃষ্টি
রাখতে হবে। পোনা
মজুদের পর প্রতি মাসে
শতাংশ প্রতি ২৫০ গ্রাম
চুন (চুন পানিতে ভিজিয়ে
রেখে ঠান্ডা করে প্রয়োগ
করতে হবে) বা ১৫০
গ্রাম জিওলাইট প্রয়োগ করতে হবে। লালন
পুকুরে পোনা মজুদের এক
মাস পর থেকে প্রতি
১৫-২০ দিন অন্তর
২০-৩০% পানি পরিবর্তন
করা ভাল।
প্রতি
১৫ দিন অন্তর পানির
গুণাগুণ যেমন পানির তাপমাত্রা,
অক্সিজেন, পিএইচ, অ্যামোনিয়া ইত্যাদি
পরীক্ষা করা ভাল।
অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বেড়ে গেলে
বাজারে প্রচলিত একোয়া কেমিক্যাল ব্যবহার
করে অ্যামোনিয়া দুরীকরণের ব্যবস্থা গ্রহন করেত হবে।লালন
পুকুরে মনোসেক্স তেলাপিয়ার খাদ্য প্রয়োগ তালিকা
আকার
। প্রয়োগ
হার । প্রয়োগ
মাত্রা
(পোনা/কেজি) (দেহের
ওজনের)
১০০ ১০% ২ বার
৮০ ৮% ২ বার
৬০ ৭% ২
বার
৫০ ৬% ২ বার
৪০ ৫% ২ বার
৩০ ৪% ২ বার
২০ ৩% ২
বার
১০- ২.৫% ২ বার
৪.
মাছ আহরণ ও উৎপাদন
আধা-নিবিড় পদ্ধতিতে চাষ
করলে ৩-৪ মাসে
ভিয়েতনাম তেলাপিয়া মাছের গড় ওজন
২০০-২৫০ গ্রাম হবে। জাল
টেনে ও পুকুর শুকিয়ে
মাছ ধরতে হবে।
এ পদ্ধতিতে ৩-৪ মাসে
একর প্রতি ৫-৬
টন উৎপাদন পাওয়া সম্ভব।
৫.
তেলাপিয়া মাছের স্বাস্থ্য/রোগ
ব্যবস্থাপনা
তেলাপিয়া
মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
বেশী হলেও চাষের পুকুরে
উচ্চ মজুদ ঘনত্ব ও
বদ্ধ জলজ পরিবেশে উচ্ছিষ্ট
খাবার, মাছের বিপাকীয় বর্জ্য
ও অন্যান্য বর্জ্য পচে পানি
দূষিত হয়ে রোগের ঝুঁকি
বৃদ্ধি পায়। কোন
খামারে একবার জীবাণু প্রবেশ
করলে তা নির্মূল করা
খুব কঠিন। তাই,
খামারে জীবাণু প্রবেশের পূর্বেই
প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহন করা উচিত।
নিম্নোক্ত
সতর্কতা অবলম্বনের মাধ্যমে রোগের ঝুঁকি কমানো
সম্ভব –
- সুস্থ
ও সবল পোনা সংগ্রহ।
- খামার
ও মাছ চাষের সকল
সরঞ্জাম জীবাণু মুক্ত রাখা।
- এক
খামারের মাছ ধরার জাল
অন্য খামারে ব্যবহার না
করা।
- উচ্চ
মজুদ হার পরিহার করা
এবং পরিমিত ও সুষম
খাবার প্রয়োগ।
- নিয়মিত
পানি পরীক্ষা করা, খামার ও
মাছের পরিচর্যা করা।
শীতকালেও
মাছ রোগাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। এই
ঝুঁকি কমানোর জন্য নিম্নোক্ত
ব্যবস্থা গ্রহন করা যেতে
পারে-
শীতের
শুরু হতে ১৫ দিন
পর পর প্রতি শতাংশে
২৫০ গ্রাম লবন ও
১৫০ গ্রাম চুন/জিওলাইট
প্রয়োগ করতে হবে। রোগের
প্রাদুর্ভাব হলে পুকুরে জীবানুনাশক
ব্যবহার করতে হবে।
প্রতি কেজি খাবারে ৫
গ্রাম অক্সিটেট্রাসাইকিন ও ২ গ্রাম
ভিটামিন-সি মিশিয়ে ১০
দিন প্রয়োগ করতে হবে।
৬.
অন্যান্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ
খাবার
প্রয়োগের ১ ঘন্টা পর
পুকুর পর্যবেণ করা উচিত।
যদি পুকুরে খাবার পাওয়া
যায় তা হলে বুঝতে
হবে পুকুর/মাছের কোন
সমস্যা হয়েছে অথবা খাবার
বেশী দেয়া হচ্ছে।
গ্রীষ্মকালে অনেক সময় পুকুরের
পানি কমে যায় ফলে
পানির তাপমাত্রা বেড়ে যায়।এক্ষেত্রে পুকুরে প্রয়োজনীয় পরিমান
পানি দিতে হবে।
একটানা মেঘলা আবহাওয়ায় কিংবা
অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে খাবারের
পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে
অথবা খাবার
দেয়া বন্ধ রাখতে হবে।
লেখক:
ড. জাহিদ পারভেজ
সুখন
পরিচালক, স্বর্ণলতা এগ্রো-ফিশারিজ লিঃ
রাধাকানাই, ফুলবাড়ীয়া, ময়মনসিংহ।
User Comments: