পুকুর প্রস্তুতি
মাছ বা চিংড়ি চাষে
ভাল উৎপাদন প্রাপ্তির জন্য পুকুর প্রস্তুতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ যা একাধিক ব্যবস্থাপনার
সমন্বয়ে সম্পন্ন হয়ে থাকে। নিচে ব্যবস্থাপনার উল্লেখযোগ্য বিষয়াদি তুলে ধরা হল-
পুকুরে প্রয়োজন মত (১.৫-২
মিটার) পানি প্রবেশ করিয়ে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনের জন্য প্রতি শতাংশে ১০০-১৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ৫০-৭৫ গ্রাম
টিএসপি সার প্রয়োগ করা যায়। অবশ্য টিএসপি সারের পরিবর্তে ডিএপি সার ব্যবহার করলে ইউরিয়ার প্রয়োগ-মাত্রা অর্ধেক হবে। এসময় প্রয়োজনে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনে সহায়ক প্রোবায়োটিক (যেমন: এ্যাকুয়া ফটো) ব্যবহার করা যেতে পারে।
পোনা বা
পিএল
লালন-পালন
মাছের ছোট পোনা বা চিংড়ির পিএল
সরাসরি মজুদ পুকুরে ছাড়া ঠিক নয়। কমপক্ষে দেড়-দুই মাস নিবিড় পরিচর্যায় রেখে লালন-পালন (Nursing) করে কিশোর মাছ বা চিংড়ি মজুদ
পুকুরে মজুদ (Stocking) করা উচিত। নার্সারি পুকুরে শতাংশ প্রতি এক থেকে দুই
হাজারটি পিএল মজুদ করা যায়। এ সময় মাটি
ও পানিতে এবং খাদ্যের সাথে ব্যবহারযোগ্য প্রোবায়োটিক প্যাকেটে বর্ণিত ব্যবহারবিধি অনুসরণে প্রয়োগ করতে হবে। উল্লেখ্য, গবেষণাকালে মাটিতে ব্যবহারযোগ্য সুপার পিএস পূর্ববর্ণিত নিয়মানুযায়ী ১৫ লিটার/হেক্টর/সপ্তাহে ১ দিন ৭.৫ কেজি বালির
সাথে মিশিয়ে এবং প্রতি কেজি খাদ্যের সাথে ব্যবহারযোগ্য ৫ গ্রাম জাইমেটিন
প্রোবায়োটিক ২০ গ্রাম মিউটাজেন
বাইন্ডার সহযোগে মিশিয়ে প্রতি সপ্তাহের প্রথম ০৪ দিন প্রয়োগ
করা হয়েছে।
পোনা বা
পিএল
মজুদ
পুকুরের ধরণ, চাষের সময়কাল, পোনার খাদ্য, খাদ্যাভ্যাস, চাষ ব্যবস্থাপনায় চাষির দক্ষতা, বিনিয়োগের ইচ্ছা ও সামর্থ্য বিবেচনায়
নিয়ে পোনার মজুদ ঘনত্ব নির্ধারণ করতে হয়। গলদা চিংড়ির একক চাষের ক্ষেত্রে শতাংশ প্রতি ৮০-১২০টি জুভেনাইল,
অতিরিক্ত প্রাকৃতিক খাদ্য নিয়ন্ত্রণের জন্য গলদা চিংড়ির সাথে প্রতি শতাংশে ৫-১০টি রুই
জাতীয় মাছ মজুদ করা যায়। মজুদ পুকুরেও লালন পুকুরের ন্যায় প্রোবায়োটিক ব্যবহার করতে হবে। গবেষণাকালে মজুদের পর হতে সম্পূর্ণ
চাষকালে পূর্ববর্ণিত একই হারে সুপার পিএস ও জাইমেটিন প্রোবায়োটিক
প্রয়োগ করা হয়েছে।
খাদ্য প্রয়োগ
মাছ ও চিংড়ির দ্রুত
বৃদ্ধির জন্য তাদের পুষ্টি চাহিদার আলোকে নিয়মিত পরিমাণমত খাদ্য প্রয়োগ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিংড়ি নার্সারির ক্ষেত্রে প্রতি হাজার পিএল এর জন্য ১ম
সপ্তাহে ২০ গ্রাম, ২য়
সপ্তাহে ৪০ গ্রাম, ৩য়
সপ্তাহে ৬০ গ্রাম, ৪র্থ
সপ্তাহে ৮০ গ্রাম স্টার্টার
ফিড প্রয়োগ করা উচিত। ৪ সপ্তাহ পর
থেকে চিংড়ির দেহের গড় ওজনের ১০-১৫% হারে সম্পূরক খাবার দেয়া, দুই মাস লালন শেষে জুভেনাইল মজুদ করার পর চিংড়ির দেহ
ওজনের ১০% হারে সম্পূরক খাবার দেয়া এবং দৈহিক ওজন ২৫-৩০ গ্রাম
হলে ৫% হারে, ৪০
গ্রাম বা তদূর্ধ্ব হলে
৩% এবং শীতকালে ডিম প্রদানের পর খাদ্য চাহিদা
কম থাকে বলে ২% হারে বা
প্রয়োজনে সাময়িকভাবে কিছুদিনের জন্য খাবার দেয়া বন্ধ রাখা যেতে পারে। প্রতিদিনের মোট খাবারকে দুই ভাগ করে সকালে ও সন্ধ্যায় একবার
করে মোট ২ বার ছিটিয়ে
দিতে হয়। চিংড়ির জন্য পিলেট জাতীয় শুকনো খাবার ব্যবহার করাই উত্তম। লালন পুকুরে প্রয়োগকৃত খাদ্যে ৩৫% এবং মজুদ পুকুরে খাদ্যে ৩০-৩২% আমিষ
থাকা উচিত। খাদ্য পরীক্ষণ ট্রে ব্যবহার করে খাদ্যের চাহিদা ও পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ
করলে খাদ্য বাবদ ব্যয় সংকোচন ও পরিবেশ ভাল
রাখা যায়। খাদ্য প্রয়োগের সময় খাদ্যে ব্যবহারযোগ্য প্রোবায়োটিক পরিমাণমত প্রয়োগ করতে হয়। গবেষণাকালে প্রতি কেজি খাদ্যের সাথে ব্যবহারযোগ্য ৫ গ্রাম জাইমেটিন
প্রোবায়োটিক ২০ গ্রাম মিউটাজেন
বাইন্ডার সহযোগে মিশিয়ে প্রতি সপ্তাহের প্রথম ০৪ দিন প্রয়োগ
করা হয়েছে।
মজুদ পরবর্তী
পরিচর্যা
ও
ব্যবস্থাপনা
চিংড়ির দ্রুত দৈহিক বৃদ্ধি ও রোগবালাই হতে
মুক্ত রাখতে পানির গুনাগুণ সঠিক মাত্রায় রাখা অত্যন্ত জরুরী। পানির গুনাগুণ ঠিক রাখতে প্রয়োজনে চুন (১২৫ কেজি/হেক্টর) প্রয়োগ করতে হবে। নিয়মিত দৈহিক বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ
করা প্রয়োজন। সময়মত ও পরিমাণ মত
খাবার দেয়া এবং পানির গুনগত মান সঠিক রাখতে পারলে কাঙ্ক্ষিত ফলন আশা করা যায়।
চিংড়ি
আহরণ
ও
বাজারজাতকরণ
কিশোর
(জুভেনাইল) চিংড়ি মজুদের ৫-৬ মাস
পর দেহের ওজন ৬০ গ্রাম বা
তদূর্ধ্ব হলে সেগুলি আহরণ করে বাজারজাত করা যেতে পারে। আংশিক আহরণের জন্য ঝাঁকি জাল ও বিশেষ ধরণের
বাঁশের চাই ব্যবহার করা যায়। চাষকাল (৮-১০ মাস)
শেষে একবারে সব চিংড়ি আহরণ
করার জন্য পুকুর শুকিয়ে নেয়া ভাল। আহরিত চিংড়ি পরিষ্কার পানিতে ধৌত করে বরফ-পানিতে (প্রায় ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস)
১০-১৫ মিনিট রেখে
আকার অনুযায়ী পৃথক করে জীবাণুমুক্ত প্লাস্টিকের ঝুড়িতে পরিমিত বরফসহ ভরে ছায়াযুক্ত বাহনে দ্রুত বাজারজাত করতে হবে। খামার বা ডিপোর অপরিচ্ছন্ন
পরিবেশে চিংড়ির মাথা বিচ্ছিন্ন করা একেবারেই ঠিক নয়। আহরণের পর পুকুর প্রস্তুত
করে পুনরায় চাষ কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
সাম্প্রতিক পরিচালিত
একটি
গবেষণায়
প্রাপ্ত
উৎপাদন
ও
আয়-ব্যয়ের
হিসাব
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা পুকুরে গলদা চিংড়ির পিএল দুই মাস লালন-পালন করে শতাংশ প্রতি ৮০টি গলদা জুভেনাইল মজুদ করে ৬ মাস ধরে
নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে চাষ করা হয়। এতে করে প্রোবায়োটিক বিহীন চাষে হেক্টর প্রতি ৬৯৪ কেজি, প্রোবায়োটিকস ব্যবহার করে চাষ করায় হেক্টর প্রতি ৯৩২ কেজি চিংড়ি উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রোবায়োটিকবিহীন চাষে প্রতি হেক্টরে ব্যয় ২,০১,০০০.০০ টাকা, ব্যয়
বাদে নীট আয় ১,৪৬,০০০.০০ টাকা। প্রোবায়োটিকসসহ
গলদা চাষে হেক্টর প্রতি প্রোবায়োটিক বাবদ ৪,৫০০০.০০
টাকা ব্যয় সহ সর্বমোট ব্যয়
২,৪৬,০০০.০০
টাকা, নীট আয় ২,২০,০০০.০০ টাকা। চাষের
বিভিন্ন পর্যায়ে প্রোবায়োটিক ব্যবহার করে একই ব্যবস্থাপনায় গলদা চাষ করে হেক্টর প্রতি ২৩৮ কেজি অধিক চিংড়ি উৎপাদন করা যায়। এছাড়াও নীট ৭৪,০০০.০০
টাকা বেশি আয় করা সম্ভব।
শেষ কথা
বাংলাদেশের মাছ ও চিংড়ি শিল্পকে
টেকসই ও পরিবেশ বান্ধব
করত: সম্ভাবনার অপার দিগন্ত খুলে দিতে পারে প্রোবায়োটিক। প্রোবায়োটিক ব্যবহার করে বিদ্যমান ক্ষতিকারক ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ
ও বিভিন্ন রোগবালাইয়ের প্রকোপ হতে সুরক্ষা দেয়া গেলে চিংড়ি চাষেই রুপালী বিপ্লব ঘটানো সম্ভব। বিদ্যমান এন্টিবায়োটিক ও রাসায়নিকের পরিবর্তে
উপকারী অণুজীব ব্যবহার করে জৈবিকভাবে চাষ করলে দেশের চিংড়ির গুনগত মান বাড়ার সাথে সাথে বিদেশি গ্রাহকদের নিকট গ্রহণযোগ্যতা ও মূল্য উভয়ই
বাড়বে। বহির্বিশ্বে রপ্তানিকৃত বাংলাদেশি চিংড়ি এন্টিবায়োটিক ও রাসায়নিকমুক্ত নিরাপদ
পণ্য হিসাবে চিহ্নিত ও স্বীকৃত হলে
এ শিল্পের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হবে। তাছাড়া বর্তমানে দেশের বাইরে থেকে আনা প্রোবায়োটিক ব্যবহৃত হওয়ায় উৎপাদন ব্যয় কিছুটা বেশি হচ্ছে। আমাদের দেশের গলদা চিংড়ির অন্ত্রে এবং এ দেশের প্রাকৃতিক
পরিবেশে বিদ্যমান উপকারী অণুজীবগুলির মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে প্রোবায়োটিক তৈরি করা গেলে উৎপাদন ব্যয় আরও কমবে তা নিশ্চিত করের
বলা যায়। এ জন্য আরও
গবেষণা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা দরকার। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি আয়ের সম্ভাবনাময় এ খাতে নতুন
আশার আলো হতে পারে প্রোবায়োটিক। এমনটিই আশাবাদ চিংড়ি চাষ সংশ্লিষ্ট গবেষক, চিংড়িচাষী, মৎস্য কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীগণের।
কৃতজ্ঞতা
স্বীকার
বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী (BAS) ও যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি
অধিদপ্তর (USDA) এর কৃষি ও
জীব বিজ্ঞান কর্মসূচির (PALS) আওতায় এ গবেষণা কাজে
আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করায় বিষয়টি কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করা হলো।
লেখক মোঃ আবুল
কালাম
আজাদ
সিনিয়র
উপজেলা মৎস্য অফিসার, মৎস্য অধিদপ্তর,
প্রকাশকাল: 26 March 2015
User Comments: