হালদা
কেবল বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব ঐতিহ্যের
অংশ। পরিবেশ
ও বিশ্ব ঐতিহ্য রক্ষা
করেই এই প্রাকৃতিক মৎস্য
প্রজনন ক্ষেত্রের উন্নয়ন করতে হবে। অন্যথায়
রুই জাতীয় মাছের অন্যতম
প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্রটি ধ্বংস
হওয়ার উপক্রম হবে।
তাই পরিবেশ ও ঐতিহ্য
রক্ষায় হালদাকে জাতীয় নদী ঘোষণা
এখন সময়ের দাবি।
হালদা
নদী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একটি
নদী। পার্বত্য
চট্টগ্রামের বাটনাতলী পাহাড় হতে উৎপন্ন
হয়ে এটি ফটিকছড়ির মধ্য
দিয়ে চট্টগ্রাম জেলায় প্রবেশ করেছে। এটি
এর পর দক্ষিণ-পশ্চিমে
ও পরে দক্ষিণে প্রবাহিত
হয়ে ফটিকছড়ির বিবিরহাট, নাজিরহাট, সাত্তারঘাট, ও অন্যান্য অংশ,
হাটহাজারী, রাউজান, এবং চট্টগ্রাম শহরের
চান্দগাঁও-বাকলিয়ার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত
হয়েছে। এটি
কালুরঘাটের নিকটে কর্ণফুলী নদীর
সাথে মিলিত হয়েছে।
এর মোট দৈর্ঘ্য ৮১
কিলোমিটার, যার মধ্যে ২৯
কিলোমিটার অংশ সারা বছর
বড় নৌকা চলাচলের উপযোগী
থাকে। এটি
পৃথিবীর একমাত্র জোয়ার-ভাটার নদী
যেখানে রুই জাতীয় মাছ
ডিম ছাড়ে এবং নিষিক্ত
ডিম সংগ্রহ করা হয়। হালদার
সাথে বাংলাদেশ এর অন্যান্য নদী
যেমন পদ্মা নদী,মেঘনা
নদী,যমুনা নদীর সংযোগ
না থাকাতে রুই জাতীয়
মাছের "জীনগত মজুদ" সম্পূর্ণ
অবিকৃত রয়েছে। হালদা
নদী কেবল প্রাকৃতিক মৎস্য
প্রজনন ঐতিহ্য নয়, এটি
ইউনেস্কোর শর্ত অনুযায়ী বিশ্ব
প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের ও যোগ্যতা রাখে।
হালদা
খালের উৎপত্তি স্থল মানিকছড়ি উপজেলার
বাটনাতলী ইউনিয়নের পাহাড়ী গ্রাম সালদা।
সালদার পাহাড়ী র্ঝণা থেকে নেমে
আসা ছড়া সালদা থেকে
হালদা নামকরণ হয়।
সালদা নদী নামে বাংলাদেশে
আরো একটি নদী আছে
যেটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য
থেকে উৎপন্ন ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলার
উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
প্রতিবছর
হালদা নদীতে একটি বিশেষ
মূহুর্তে ও বিশেষ পরিবেশে
রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউস
ও কার্প জাতীয় মাতৃমাছ
প্রচুর পরিমাণ ডিম ছাড়ে। ডিম
ছাড়ার বিশেষ সময়কে "তিথি"
বলা হয়ে থাকে।
মা মাছেরা এপ্রিল থেকে
জুন পর্যন্ত শুধু অমাবস্যা বা
পূর্ণিমার তিথিতে অনুকূল পরিবেশে
ডিম ছাড়ে। ডিম
ছাড়ার এই বিশেষ সময়কে
স্থানীয়রা "জো" বলে। এই
জো এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে
অমাবস্যা বা পূর্ণিমা হতে
হবে, সেই সাথে প্রচণ্ড
বজ্রপাতসহ বৃষ্টিপাত হতে হবে;- এই
বৃষ্টিপাত শুধু স্থানীয় ভাবে
হলে হবে না, তা
নদীর উজানেও হতে হবে। ফলে
নদীতে পাহাড়ি ঢলের সৃষ্টি হয়। এতে
পানি অত্যন্ত ঘোলা ও খরস্রোতা
হয়ে ফেনাকারে প্রবাহিত হয়। জো
এর সর্বশেষ বৈশিষ্ট্য হল নদীর জোয়ার-ভাটার জন্য অপেক্ষা
করা। পূর্ণ
জোয়ারের শেষে অথবা পূর্ণ
ভাটার শেষে পানি যখন
স্থির হয় তখনই কেবল
মা মাছ ডিম ছাড়ে। মা
মাছেরা ডিম ছাড়ার আগে
পরীক্ষামূলক ভাবে অল্প ডিম
ছাড়ে। ডিম
ছাড়ার অনুকূল পরিবেশ না
পেলে মা মাছ ডিম
নিজের দেহের মধ্যে নষ্ট
করে দেয়। ডিম
সংগ্রহ করে জেলেরা বিভিন্ন
বাণিজ্যিক হ্যাচারিতে উচ্চমূল্যে বিক্রি করেন।
নদী
হিসেবে এর গুরুত্ব যতখানি
তারচেয়েও প্রাকৃতিক এই মৎস্য প্রজনন
ক্ষেত্রের গুরুত্ব অনেক বেশি।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের
মতে, দেশে ৫৪ প্রজাতির
মাছ চরম বিপর্ণ দশায়
রয়েছে। সংকটাপন্ন
প্রায় ১২০ প্রজাতির মাছ। ইতোমধ্যেই
বিলুপ্ত হয়ে গেছে ৪
প্রজাতির মাছ। বাজারে
মিঠা পানির মাছ হিসেবে
যা বিক্রি হচ্ছে, তার
অধিকাংশই চাষের মাছ।
মাছের অভয় আশ্রমগুলো হারিয়ে
গেছে এবং যাচ্ছে।
সেই বিবেচনায় হালদানদীর গুরুত্ব অনেক বেশি।
রুইসহ কার্প জাতীয় মাছের
একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র এটি। এই
নদীর রুই মাছের রেণু
সারা দেশের চাহিদার ৮০
শতাংশ পূরণ করে।
তবে
বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকান্ডে নদীটি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। স্থানীয়
সরকার প্রকৌশল বিভাগের স্থাপিত রাবারড্যামের কারণে হালদার পানিপ্রবাহ
কমে যাওয়ায় মা মাছের
ডিম ছাড়া কমে গিয়েছিল। অন্যদিকে
যথাযথ উদ্যোগ ও পরিকল্পনা
না থাকার কারণেও প্রাকৃতিক
এই মৎস্য ভান্ডার হুমকির
মুখে রয়েছে মানবসৃষ্ট অনাসৃষ্টি
হালদার অস্তিত্বের জন্য মারাত্মক হুমকি
হয়ে দেখা দিয়েছে।
প্রথমত পলি জমেছে এবং
নদীর বাঁকগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নদীতে
হাতজাল, ভাসাজাল, মশারিজাল, ইঞ্জিনচালিত নৌকা, অবৈধ বালি
তোলার ড্রেজার মেশিন ব্যবহারের কারণেও
নদীটি মাছের ডিম ছাড়ার
অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে স্রোতস্বীনি এই
নদীর যে বাঁকগুলো মাছের
নিরাপদ প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে
বিবেচিত হতো গত ৬০
বছরে তা ভেঙ্গে ফেলা
হয়েছে। এই
বাস্তবতায় হালদানদী এবং হাওড়-বাঁওর
খাল-বিল ও নদ-নদীতে মাছের অভয়াশ্রম
সংরক্ষণে সচেতন হবার কোন
বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে
অবশ্যই সকলেরই মনে রাখা
দরকার, কাজটা কারো একার
নয়। সবাই
মিলেই নদীর স্বাভাবিক পরিবেশ
বজায় রাখতে হবে।
মাছকে
কেন্দ্র করে আমাদের অর্থনীতির
একটি বড় অংশ আবর্তিত
হচ্ছে। সবকিছু
বিবেচনা করেই এটা বলা
যায়, যেহেতু আমাদের দেশে
প্রাকৃতিক মাছের ঊৎসের এক
বড় অংশের সরবরাহ আসে
হালদা নদী থেকে, তাই
হালদা নদী ও সেখানে
মাছের অভয়াশ্রমকে অত্যাধিক গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা
জরুরি। নদী
তীরবর্তীরাসহ সকলেই এ ব্যাপারে
সচেতন ও যত্নবান হবেন-
এটাই প্রত্যাশিত।
হালদাকে
জাতীয় নদী ঘোষানা করে
এর যথাযত রক্ষনা বেক্ষনের
ব্যবস্থা করা না হলে
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক মৎস্য ডিম ছাড়ার
এই হেরিটেজ হারিয়ে যাবে চীরতরে।
User Comments: